Monday, October 21, 2013

লাবণ্যর চিঠি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত কে লেখা লাবণ্যর শেষ চিঠি।
--

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু'সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয় না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপখক হতে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়

অপরূপ বাগান

আবুল হাসান
......................
চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহ পলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক !
তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?
জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন !
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি !
অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি !
ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ;
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান-
আর লোকে দেখে ভাববে- বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে !

Tuesday, September 11, 2012

তাসের প্রাসাদ

কবি: জাফর সাদেক চৌধুরী।
......................................

রমনার বিকেল আলোয় মেলতো ডানা
স্বপ্ন নিয়ে উড়তো তারা নেইতো মানা।
একযুগলের দেখা হোতো বিকেল বেলা,
সেই যুগলের হৃদয় জুড়ে স্বপ্ন খেলা।

নাগলিঙ্গম গাছের নিচে বসতো দু’জন
নগরজুড়ে মিলতো অবাক পাখির কূজন।
গুনতো শুধু কখন হবে আঁধার কালো,

সেই আঁধারে সুখের মেলা জমতো ভালো।

অপাংক্তেয়-পল্লী যেমন কারো জীবন,
বিনা পাপে খুঁজতো তারা উষ্ণ মিলন।
সেই মিলনে কাম ছিলনা মরণ নেশা,
সিক্ত হতো প্রেমের নদী ভালোবাসা।
ভালোবাসার মাঝে অনেক স্বপ্নবাজি,
ঘর বানাবে সাজবে অনেক পুষ্পরাজি।

তারপর এক তাসের মতো প্রাসাদ হোলো,
প্রাসাদ-জীবন ভালোবাসা মলিন হোলো।
সেই জীবনে একটুখানি হিসাব-নিকাশ,
সেই হিসাবে হঠাৎ কেমন আঁধার আকাশ।
আঁধার আকাশ জুড়ে কালো মেঘের মেলা,
সেই মেলাতে হারিয়ে গেল বিকেল বেলা।
তাসের প্রাসাদ ধ্বংস হোলো ছেলেখেলায়,
দু’জন ভাবে দুই নগরে বিকেল বেলায় ।

নষ্ট ঘড়ির অচল বেলা

কবি: জাফর সাদেক চৌধুরী
..............................................
 এক শহরের এক কোণেতে রৌদ্র দুপুর
পাখির ডাকের শেওলা দেয়াল হারিয়ে গেল
হঠাত করে তরতরিয়ে চিলেকোঠার চড়ইপাখি
অবুঝমনে স্বপ্ন জালে সেই দেয়ালের সঙ্গী হল।

সেই শহরের প্রাণের ছোঁয়া কিশোরমেলা
চঞ্চলতার ঘুড়ি ফেলে বিকেল আলোয়
পথ ভুলে আজ ঘরের কোণে সঙ্গীহারা

সবুজ ছেড়ে নষ্ট খেলা আঁধার কালোয় ।

মানুষগুলো সাহসহারা আজব জীবন
সেই জীবনের ভাঁজে ভাজে কষ্ট ছায়া
সময় গুলো নষ্ট ঘড়ির অচল বেলা
সবই করে ভুলছে শুধু মাটির মায়া।

স্বার্থ চেনা সেই সময়ের সঙ্গী হলাম
সবুজ বাদাড় পাহাড় কেটে ঘর বনালাম
নিজের মতো মরা দ্বীপের ছবি এঁকে
আপনমনে অতীত ভুলে ঘর সাজালাম।

সেই শহরের স্রোতস্বিনী খুন হয়েছে
আমার হাতে দিন দুপুরে দেখল সবাই
কী যায় তাতে কেউ কাঁদে না
কাজ ভুলে সব নষ্ট ছবি করছে বাঁধাই।

রক্তের সুতোয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল

কবি: জাফর সাদেক চৌধুরী
....................................
 চোখে দেখা লাগে না শব্দস্রোতে যায় চেনা
কণ্ঠ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ কনার কম্পনাঙ্ক
প্রেমিকের হৃদয়ে জন্ম দিত চেতনার প্রজ্বলন
লাঠি হাতে ট্যাঙ্কের সামনে যাওয়ার অদম্যতা।

প্রতিটি শব্দ কনিকা ছিল বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গের মতো
তীব্র ধাবমান অজানা গ্যালাক্সির ক্ষিপ্র নভোযান
দিগন্ত ছিন্ন করা লক্ষ আলোকবর্ষ দৈর্ঘ্যের এক মুক্ত স্বপ্ন

জয় বাংলা জয় বাংলা জয় বাংলা ।

জয় বাংলা কোনো শব্দ নয় একটি দীক্ষা
এই দীক্ষাতে সুপ্ত ছিল পশুদের হননের মন্ত্র
যেই মন্ত্র নিজে রক্তাক্ত হয়ে ছিন্ন করে শত্রুর মস্তক
সেই মন্ত্রে ৩২ লক্ষ দীপ জ্বলে উঠে ১৫ কোটি চোখে।

এক তর্জনীর গর্জনে কোটি জীবন ছুটে মৃত্যুর পানে
লক্ষ জীবন স্বপ্ন মায়ায় বিবর্তিত হয়ে এক সাগর রক্ত
রক্তের সুতোয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল মায়ের আঁচল
মায়ের আঁচলে পরম মমতায় আঁকা হল বাংলাদেশ।

Wednesday, January 18, 2012

রিপোর্ট ১৯৭১ আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।

মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।

এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।

আসাদ চৌধুরী
..................
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।

Monday, December 5, 2011

প্যারিসের চিঠি

লতিফুল ইসলাম শিবলী
...................
প্রিয় আকাশি,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি । খামের উপর নাম ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি তোমার হাতের লেখা , ঠিকানা পেলে কিভাবে লিখনি ,
কতদিন পর ঢাকার চিঠি, তাও তোমার হাতের লেখা,
ভাবতে পারো আমার অবস্থা ?

গতকাল প্যারিসে ঝড়েছিল এ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তুষারপাত ।
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি
এই প্রথম আমি অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ ।

তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর বদলে যাওয়ার সংবাদ
তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছো,
রাত্রির ঢাকা এখন নিয়নের স্নিগ্ধতা ছেড়ে নিয়েছে,
উৎকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন কালের সাক্ষী,
শীতের বই মেলা পরিনত হয়েছে মিনাবাজারে,
টি এস সি র চত্বর যেন উত্তপ্ত বৈরুত।

বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্মৃতি,
এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছো,
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও
বদলে যেতে দেখলাম কত সুদৃঢ় ইতিহাস
বালির বাঁধের মত ভেসে গেল পুর্ব ইউরোপ
নদীর পাড় ভাঙ্গার মত ভেঙ্গে গেল বার্লিন প্রাচীর
ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে ,
ক্ষিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও …
স্বাধীনতা মানেই যেন উদর পুর্তি

তুমি লিখেছ “তোমাকে ভুলে গেছি কিনা ?”

প্রিয় আকাশি,
আমি জেনে গেছি
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ
ভুলে থাকা।
স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য
এই সুদীর্ঘ প্রবাসের অর্ধেকটা কাটিয়েছি
বোহেমিয়ানদের মত ঘুরে ঘুরে
মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ,
নিউক্যাসল্ নেপোলি থেকে প্রাগ বুখারেষ্ট মাসিডোনিয়া
নর্থ সি থেকে মেডিটোরিয়ান কিংবা ব্ল্যাক সি।
তবু বাঁচতে পারিনি স্মৃতি থেকে,
ফ্রাঙ্কফুটের বই মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসটাইন চ্যাপেলের “লাষ্ট জাজমেণ্টে”র মত মহান সৃষ্টি পিয়েতা”র সামনে দাঁড়িয়ে
প্রথমেই মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসিলির কার্নিভেলে
এথেন্সের কফি শপের জমজমাট কবিতা পাঠের আসরে, মনে পড়েছে তোমাকে ।
সুইজারল্যন্ডের লেকের কাছে স্বচ্চ জলে নিজের ছায়ার পাশে যাকে খুঁজেছি,সে তুমি।
ভ্যাটিক্যানের প্রার্থনা সভা শেষে
এক গ্রীক তরুনীকে বাংলায় কি বলেছিলাম জানো ?
বলেছিলাম- “তুমি আমার আকাশী হবে ?”
ভুলতে পারিনি তোমাকে,
শত চেষ্টা করেও পারিনি ।

আর কেউ না জানুক
অসংখ্য জিপসি রাত জানে সেই না ভুলতে পারার ইতিহাস।

তুমি জানতে চেয়েছো প্যারিসের কথা -
সত্যি বলতে কি -
প্যারিস খুলে দিয়েছে আমার আত্নার চোখ
সংগীত আর শিল্পের অভিন্ন সুর আমি শুধু প্যারিসেই শুনেছি ।
ক্লিয়নে কনসার্টে যতবার মোৎসার্ট
কিংবা বিটোভেন শুনেছি
ততবারই কেন যেন চিরদুঃখী পাগল ভিনসেন্ট ভ্যানগগের কথা মনে পড়েছে।
সমস্ত প্যারিসের রাস্তায়, গ্যালারিতে, ফেষ্টিভেলে ,খুঁজে ফিরেছি ভিনসেন্টের কষ্ট ।
তোমার প্রিয় গায়ক
জিম মরিসনের শেষ দিনগুলো কেটেছে এই প্যারিসে ।
প্যারিসেই জিমের কবর ।
অগনিত শিল্পীর কষ্ট থেকে প্যারিস পেয়েছে সৌন্দর্য,
কষ্টই প্যারিসের ঐশ্বর্য ।

আমাদের সুবর্ন সময়ের স্বপ্নের প্যারিসে
আজ নিজেকে ভীষন একা মনে হয়
এলোমালো পড়ে আছি
শিল্প সাহিত্যের এই জাগ যজ্ঞে।
তীব্র শীতের শ্বাসকষ্ট ভোগায় মাঝে মাঝে
এইতো সেদিন
আবারও বদলালাম চশমার কাঁচ।
প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি, সময়ের কাছে,
তুমি মনে রেখো
পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায়
আমি বদলাইনি এতটুকু ।
বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মত
তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ ।
তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে ওঠো তোমার সৃষ্টিতে ।

তুমি ভালো থেকো …….

Wednesday, September 7, 2011

আকাশ – নির্মলেন্দু গুন

নির্মলেন্দু গুন
.............
আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…”আকাশ” ।

আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি ।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না ।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত আকাশ শব্দটি ।

তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
অনেক আকাশ । – আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে ।

ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ

– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
..................
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।

নিজের কানে কানে

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.........................
এক এক সময় মনে হয়, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই
এক এক সময় মনে হয়
পৃথিবীটাকে দেখে যাবো শেষ পর্যন্ত!
এক এক সময় মানুষের ওপর রেগে উঠি
অথচ ভালোবাসা তো কারুকে দিতে হবে
জন্তু-জানোয়ার গাছপালাদের আমি ওসব
দিতে পারি না
এক এক সময় ইচ্ছে হয়
সব কিছু ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড করে ফেলি
আবার কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে
ইচ্ছে হয় কিছু একটা তৈরি করে গেলে মন্দ হয় না।

হঠাৎ কখনো দেখতে পাই সহস্র চোখ মেলে
তাকিয়ে আছে সুন্দর
কেউ যেন ডেকে বলছে, এসো এসো,
কতক্ষণ ধরে বসে আমি তোমার জন্য
মনে পড়ে বন্ধুদের মুখ, যারা শত্রু হতেও তো পারতো
মনে পরে হালকা শত্রুদের, যারাও হয়তো কখনো
আবার বন্ধু হবে
নদীর কিনারে গিয়ে মনে পড়ে নদীর চেয়েও উত্তাল সুগভীর নারীকে
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না!

Wednesday, August 10, 2011

আমেরিকা: আপডেটেড

নির্মলেন্দু গুন
................
আমেরিকা, কলম্বাস কর্তৃক আবিস্কৃত
হে মহান গণতন্ত্রের দেশ -,
মানবাধিকারের হে অতন্দ্র প্রহরী!
তোমাকে সালাম, তোমাকে নমস্কার।

আমেরিকা, – আমি ভেবেছিলাম ,
সোভিয়েত ইঊনিয়নহীন পৃথিবীতে
তুমি আরো দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে।
তোমার দৈত্যদন্তগুলো ফেলে দিয়ে,
ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠবে তুমি।

মানুষ কেন তার নিজ জীবনের চেয়ে
ভালোবাসবে তোমার ক্ষতিকে?
ভেবেছিলাম, ১১ সেপ্টেম্বরের পর,
ঘৃণার উৎস সন্ধানে ব্রতী হবে তুমি।
আমি ভেবেছিলাম, তুমি অতঃপর
আত্মঘাতী প্রাণের গভীরে প্রবেশ করে
বুঝতে চেষ্টা করবে তার ব্যথা।

কিন্তু আমেরিকা, শক্তিমদমত্ত বিশ্বপ্রভু,
ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন না করে,
ইতিহাসকেই শিক্ষা দিতে চাইছ তুমি।
তাই, তোমার সন্দেহতাড়িত শক্তি,
অঢেল সম্পদের দম্ভ তোমার দৃষ্টিকে
আচ্ছন্ন করেছে, মদ যে রকম মাতালকে।

আমেরিকা, তুমি বুঝতে পারছো না-
নির্বান্ধবতার অন্ধ আবর্তের দিকে
কীভাবে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছো তুমি।

আমেরিকা, তুমি বুঝতে পারছো না –
কীভাবে ক্রমশ তুমি পরিণত হচ্ছো
পাপ আর অন্যায়ের উৎসভূমিতে?

প্রপিতামহের সঙ্গে জোট বেঁধে –
জাতিসংঘকে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে,

ধর্মনিরপেক্ষ ইরাককে ধ্বংস করে
তুমি তোমার নিজের গণ

বিধ্বংসী
দৈত্যমূর্তিকেই উলঙ্গ করেছো।

সাদ্দাম হোসেনের পুত্ররা
কী ক্ষতি করেছিল বুশ-কন্যাদের?
তুমি তাদের হত্যা করেছো কেন?

আফগানিস্তান ও ইরাকের অগণিত
শিশু-নারী আর নিরীহ মানুষকে
তুমি হত্যা করেছো -, তুমি খুনি।

তুমি বিন-লাদেনকে শিখন্ডি বানিয়ে
বিশ্বগ্রাসের যে নাটক সাজিয়েছো,
নিপাতনে সিদ্ধ হবে তার যবনিকা।

মানুষকে সহজেই বধ করা সম্ভব,
কিন্তু ভয় দেখিয়ে – মানুষ কেন?
কুকুরকেও বশ করা যায় না।
ভয় হচেছ ভূতের এজেন্ডা,
ইমপিরিলিজমের লিগেসি।

আমেরিকা, তুমি শোনো, আমি চাই -
তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ো,
আর সদাপ্রভু দয়াল যিশুর নামে
শুদ্ধচিত্তে তুমি পাঠ করো বাইবেল।

ট্রিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করে
যে লৌহবাসর তৈরি করছো তুমি-
তাতে,- তাতে আর যাই থাক,
মিলনের আনন্দ থাকবে না।
আমেরিকা, তুমি একা হয়ে যাবে,
একা হয়ে যাবে,-বড় বেশি একা।

অ্যালেন গিন্‌সবার্গ বেঁচে থাকলে
এ কথাই তোমাকে বলতেন;
আর দুঃখ পেতেন বুশের বিজয়ে।

উল্টোরথ

নির্মলেন্দু গুন
............
শুধু চোখে নয়, হাত দিয়ে হাত,
মুখ দিয়ে মুখ, বুক দিয়ে বুক ;
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট খোলো, এইভাবে
খুলে খুলে তোমাকে দেখাও ।
শুধু চোখে নয়, নখ দিয়ে নখ,
চুল দিয়ে চুল, আঙুলে আঙুল;
হাঁটু দিয়ে হাঁটু, উরু দিয়ে উরু,
আর এটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাও ।

শুধু চোখে নয়, চোখে চোখে চোখ,
বাহু দিয়ে বাহু, নাভি দিয়ে নাভি;
চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি,
তালা দিয়ে খোলো দেখি চাবি ?

টেলিফোনে প্রস্তাব

নির্মলেন্দু গুন
...........................
আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই,
অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের
দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই
অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে।
তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে-
আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি
তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে।

তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি,
আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা।
কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা,
তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো?
অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর,
আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী।
কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো
স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়।

তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো,
তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি।

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু

নির্মলেন্দু গুন
.............
একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।
একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।
একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

Monday, August 8, 2011

যে আমাকে প্রেম শেখালো

মাকিদ হায়দার
..............
যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

সে যেন আজ রানীর মত
ব্যক্তিগত রাজ্যপাটে
পা ছড়িয়ে সবার কাছে
বসতে পারে
বলতে পারে মনের কথা
চোখের তারায়
হাত ইশারায়

ঐ যে দেখ দুঃখি প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর

কিন্তু শোন প্রজাবৃন্দ
দুঃসময়ে সেই তো ছিলো
বুকের কাছে হৃদয় মাঝে
আজকে তারে দেখলে শুধু
ইচ্ছে করে
চোখের পাতায় অধর রাখি

যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে চিনিয়েছিলো
দুষ্টু গ্রহ অরুন্ধতী
বৃষ্টি ভেজা চতুর্দশী
জোৎস্না রাতের উজ্জ্বলতা
ভোরের বকুল শুভ্র মালা
নগর নাগর ভদ্র ইতর
রাজার বাড়ি
সেই তো আবার বুঝিয়েছিলো

যাওগো চলে আমায় ছেড়ে

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

নিজের দেহে আগুন জ্বেলে
ভেবেছিলাম
নিখাদ সোনা হবোই আমি
শীত বিকেলের টুকরো স্মৃতি
রাখবো ধরে সবার মত
হৃদয় বীণার মোহন তারে
ভুলেই গেলাম
যখন তুমি আমায় ডেকে
বললে শুধু

পথের এখন অনেক বাকি
যাও গো শোভন
যাও গো চলে বহুদুরে
কণ্ঠে আমার অনেক তৃষা
যাও গো চলে আপন পথে

এই না বলেই
হাসলে শুধু করুন ঠোঁটে
বাজলো দুরে শঙ্খ নিনাদ
কাঁদলো আমার বুকের পাথর
কাঁদলো দুরে হাজার তারা
একলা থাকার গভীর রাতে
একলা জাগার তিন প্রহরে

তাইতো বলি সবার কাছে
যে আমাকে দুঃখ দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে বুকের মাঝে
অনল দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে

সুখেই থাকে

Saturday, July 23, 2011

চির অনাবৃতা হে নগ্নতমা

নির্মলেন্দু গুণ
................
চির অনাবৃতা হে নগ্নতমা
নদীর জল তোমাকে যেভাবে পেয়েছে
আমি সেভাবে পাই নি!

লাক্স সাবান যেভাবে তোমাকে ছুঁয়েছে
আমি সেভাবে ছুঁইনি।
মেডলিন লিপস্টিক যেভাবে তোমাকে চুমু খেয়েছে
আমি সে সুযোগ পাই নি।

প্রসাধন ঘরের চারদেয়াল তোমাকে যেভাবে দেখেছে
আমি সেভাবে তোমাকে দেখিনি।
গাঢ় অন্ধকার যেভাবে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে
আমি তো তা পারি নি।

দিনের আলো যেভাবে তোমাকে দূরে সরিয়েছে
আমি সে প্রশ্রয় পাই নি
বেসিনের জল যেভাবে তোমার হাত ধরেছে
আমি সে সুযোগও পাই নি

তোমার হাতের বই বুক পর্যন্ত যেভাবে গড়িয়েছে
দেখে তো আমার ঈর্ষাই হয়েছে
এভাবে স্পর্শকাতর কবি ঈর্ষাকাতর হয়েছে
করেছে ভ্রমণ স্বপ্নের ভিতর
ঘুরেছে ঘোরে ঘোর ঘোরতর।

ম্যাক্সির ভিতর যেভাবে তুমি ঢুকেছো
আমার আলিঙ্গনে সেভাবে তুমি আসো নি
রাতের আকাশ যেভাবে তোমাকে দেখেছে
বৃষ্টির জল যেভাবে তোমাকে জড়িয়েছে
দিনের সূর্য যে উত্তাপ তোমাকে দিয়েছে
তোমার শরীরে পৃথিবীর পরে
আমি সে সুযোগ পাই নি।

ভোরের বায়ু তোমার এলায়িত চুলে
যেভাবে হাত বুলিয়েছে
এই কবি কি সে সুযোগ পেয়েছে?
ভিনদেশী পারফিউম তোমার গাঁয়ে যেভাবে গন্ধ মেখেছে
এই কবি কি তা পেরেছে?

Wednesday, July 20, 2011

ফেসবুক গ্রুপে আমন্ত্রণ

প্রিয় ভিজিটর, আপনাকে ফেসবুক গ্রুপে আমন্ত্রণ জানাই। ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন কবিতার খাতা

Tuesday, July 19, 2011

তোমাকে

জীবনানন্দ দাস
............
মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্রে অই;
কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে
হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো
রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে
বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি?
কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত ক’রে।
রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে-
নারীর,-তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির।
আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু
অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে
আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হ’লে
বলেঃ ‘আমি রোদ কি ধূলো পাখি না সেই নারী?’
পাতা পাথর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি;
নদী শিশির পাখি বাতাস কথা ব;লে ফুরিয়ে গেলে পরে
শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে
সফল হ’তে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো।
যদিও পথ আছে-তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে
নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;
প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-
কী বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।
তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসেঃ মানবপ্রতিভার
রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে।
মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে
বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।

Monday, July 11, 2011

স্বভাব

জীবনানন্দ দাস
.........
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ'লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক'রে চলে;
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে
সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ
তা'হলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়
দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে;
যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ
আচ্ছন্ন মাছির মত মরে -
তবুও একটি নারী 'ভোরের নদীর
জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে'
এ রকম দু-চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা
ভেবে শেষ হ'য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে।

লোকেন বোসের জর্নাল

জীবনানন্দ দাশে
..............
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।

পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
নাড়বো না আমি
নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —
কিন্তু কথাটা থাক;
কিন্তু তবুও —
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে
এখন কি করে মন কারভান হবে।

প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৼ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সৼ নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
কখন সময় হবে।

হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —
হৃদয় কেন যে কাঁপে,
'ভালোবাসতাম' — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে
তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে
এর উত্তর হবে?

সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

Friday, June 10, 2011

হঠাৎ দেখা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
...........................
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু --
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্‌, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।

Monday, June 6, 2011

সে তোমাকে পাবে না।

মইনুল আহসান সাবের
................
একা একা ভালবেসে এইভাবে বেড়ে যায় পাপ,
তুমি কোনদিন দেখবেনা, তার দুঃখ অনুস্তাপ।
কোন কোন মাঝ রাতে বৃষ্টি হবে,
সে তখন তোমাকে পাবেনা।
বৃষ্টি যেমন ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর বস্ত্র হরণ করে,
টানে টানে খসে যায় আবরণ,
পরে থাকে বিশুদ্ধ যৌবন
ঠিক সেই ভাবে বস্ত্র হরণ করেও,
সে তোমাকে পাবেনা।
কোন কোন দুপুরে নীল আকাশে ভেসে যাবে একা চিল,
সে তখন তোমাকে পাবেনা।
আকাশের মত বিস্তৃত করেও,
সে তোমাকে পাবেনা।
সে তোমার ঠোঁট ছোঁবে, স্তনাগ্র, তোমার চিবুক,
তবু মাঝ রাতে বৃষ্টি হলে তুমি তার হবেনা।

তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টি হলে কেন তুমি ভেসে যাও
কে তোমায় বাজায় তখন,
কার কন্ঠে গান গায় একান্তের স্মৃতি,
কোন সে হাত এসে সিঁথি কাটে তোমার চুলে,
তোমাকে শয্যা থেকে তুলে নেয়,
তোমাকে তোমার শরীর থেকে তুলে নেয়,
কোন সে পুরুষ?
তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, বোঝেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টির অর্থ,
জানেনা নির্জন করিডোরে নতজানু এক নিঃসঙ্গ যুবক,
তোমাকে মাঝরাতে বৃষ্টির কথা বলেছিল,
তোমার চমকিত চোখে বরিষন দেখেছে সে,
বলেছিল তোমার নিজস্ব পুরুষ সে তো জানেনা,
নিজস্ব ছাড়িয়ে আরো কিছু থাকে।

Wednesday, June 1, 2011

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

জীবনানন্দ দাস
..................
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাহাদের হৃদয়।

তোমায় আমি

জীবনানন্দ দাস
...........
তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।

তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।

জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।

Sunday, May 22, 2011

দীর্ঘশ্বাসের পাখি

সোহরাব হাসান
............
আমার দীর্ঘশ্বাসের চেয়ে বড় কোনো সড়ক নেই এই শহরে
তুমি যে পথে যাবে, যে গলিতে পা রাখবে বলে
মনস্থির করেছ; সেখানেই আমাকে পাবে।

আমি ছায়াহীন মানুষ
সহস্র আলোকবর্ষ ঠায় দাঁড়িয়ে আছি
আমি তোমাদের আলোঝলমলে এ শহরে
কোনো ছাড়পত্র নিয়ে আসিনি, অর্বাচীনের মতো ঢুকে পড়েছি।

মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো আকাশ নেই
অথচ তোমরা আকাশের চেয়ে কংক্রিট নিয়ে মেতে থাকো
মৃত্তিকালীন মানুষের চেহারা ভীষণ অপছন্দ তোমাদের
বলো, আমি যদি আঁধারকে কাছে টেনে না নিতাম
তোমরা আলো চিনতে কী করে?
তোমরা কেউ আমার কষ্ট বুঝলে না , হয়তো আমিও
তোমাদের অনুভবের সাগর ছুঁতে পারিনি।
অনুতাপহীন মানুষের দেশে আমি দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেঁচে আছি।

Tuesday, February 8, 2011

আবার যখনই দেখা হবে

নির্মলেন্দু গুণ
.........
আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।

এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে, জাগাবো না, নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।

‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

Sunday, December 19, 2010

আরও নিচে

আরও নিচে
.........
সিংহাসন থেকে একটু নিচে নেমে, পাথরের
সিঁড়ির উপর বসে থাকি
একা, চিবুক নির্ভরশীল
চোখ লোকচক্ষু থেকে দূরে।
‘সম্রাটের চেয়ে কিছু কম সম্রাটত্ব’ থেকে ছুটি নিয়ে আজ
হলুদ দিনাবসানে পরিকীর্ণ শব্দটির মোহে
মাটির মানুষ হতে সাধ হয়। এক-একদিন একরকম হয়।
আমার চোখের নীচে কালো দাগ
ব্যান্ডেজের মধ্যে একটা পোকা ঢুকলে যে-রকম জাদুদন্ডসম কোনো
মহিলার মতো
নিয়তি বদল করে, আলো-ছায়া-আলো ঘোরে নিভৃত সানুদেশে
দপ করে জ্বলে ওঠে হৃদয়ের পুরনো বারুদ
তেমনিই দিনাবসান
তেমনিই মোহের থেকে মুক্ত নিচু চাঁদ-
সিংহাসন থেকে নেমে, হাত ভরা পশমের মতো
রোমশ স্তব্ধতা।

পাথরের মতো মসৃণ বেদির নিচে রুক্ষ মাটি, একটু দূরে পায়ে চলা পথ।
সম্রাটের শেষ বৃত্য চিরতরে যেখানে শয়ান
তার চেয়ে দূরে, সীমার যেখানে শেষ
সেখানে উদ্ভিদ, জল মেতে আছে পাংশু ঈর্ষায়
যেখানে বিশীর্ণ হাত কাদার ভেতর খোঁজ বলির ফসল
তার চেয়ে দূরে
যেখানে শামুক তার খাদ্য পায়, নিজেও সে খাদ্য হয়
ভেসে যায় সাপের খোলস, সেখানেও
আমার অতৃপ্তি বড় দীর্ঘশ্বাস বিষদৃষ্টি নিয়ে জেগে রয়-
মুকুট খোলার পর আমি আরও বহুদূরে নেমে যেতে চাই।।

এক একদিন উদাসীন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
...........
এমনও তো হয় কোনোদিন
পৃথিবী বন্ধবহীন
তুমি যাও রেলব্রীজে এক-
ধূসর সন্ধ্যায় নামে ছায়া
নদীটিও স্থিরকায়া
বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।
ইস্টিশানে অতি ক্ষীণ আলো
তাও কে বেসেছে ভালো
এত প্রিয় এখন দ্যুলোক
হে মানুষ, বিস্মৃত নিমেষে
তুমিও বলেছো হেসে
বেঁচে থাকা স্বপ্নভাঙা শোক!
মনে পড়ে সেই মিথ্যে নেশা?
দাপটে উল্লাসে মেশা
অহঙ্কারী হাতে তরবারী
লোভী দুই চক্ষু চেয়েছিল
সোনার রূপোর ধুলো
প্রভুত্বের বেদী কিংবা নারী!
আজ সবকিছু ফেলে এলে
সূর্য রক্তে ডুবে গেলে
রেলব্রীজে একা কার হাসি?
হাহাকার মেশা উচ্চারণে
কে বলে আপন মনে
আমি পরিত্রাণ ভালোবাসি!

জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.............
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না
মৃত্যু হয় না-
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।
আমার কেউ নাম রখেনি, তিনটে
চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধীমে,
আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার
হাত পুড়ে যায়
অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমায়ায়
অন্ধকারে মিশে থেকেছি
কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোনো ভয় হয় না
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।।

নারী ও শিল্প

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
............
ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি
উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা
এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা
দর্পণের ঘরে বস
চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে
সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল
থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে

আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো
তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব
আমি তার ওষ্ঠ ও উরুতে মুখ গুঁজে
জানাই সেই খবর
কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না।

তুমি যেখানেই যাও

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.............
তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি য়েলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?

তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি
তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেঁসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না
আয়না
ভেঙে
বিচ্ছুরণ
একদিন
বিস্ফোরণ হয়
বুক ভেঙে কান্না এলে কান্নাগুলি ছুটে যায় ধূসর অন্তিমে স্বর্গের অলিন্দে-
স্বর্গ থেকে
তারপর ঢলে পড়ে
মহিম হালদার স্ট্রীটে
প্রাচীন গহ্বরে
মধ্যরাতে।

জানলা ভেঙে বৃষ্টি এলে বুকে যে-রকম পাপ হয়
যে-রকম স্মৃতিহীন মহিম হালদার কিংবা আমি ও মোহিনী
পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রী-শরীর চরিত্র নদীর……
দীপকের মাথাব্যথা হাঁসের পালক ছুঁয়ে হাসাহাসি করে
যে-রকম শান্তিনিকেতন কোনো ত্রিভুবনে নেই
দীপক ও তারাপদ দুই কম্বুকন্ঠ জেগে রয়…….
যে রকম তারাপদ গান গায় গোটা উপন্যাসে সুর দেয়া
কবিতার লাইন ছুঁড়ে পাগলা-ঘন্টি বাজিয়ে ঘুরেছে-

নিকষ বৃত্তের থেকে চোখগুলি ঘোরে ও ঘুমোয়,
শিয়রে পায়ের কাছে বই-বই-বই
তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে।
আরো নিজে পাপোশের নিচে এক আহিরীটোলায়
বৃষ্টি পড়ে,
রোদ আসে,
বিড়ালীর সঙ্গে খেলে
বেজম্মা বালিকা-
ছাদে পায়চারি করে গিরগিটি,

শেয়াল ঢুকেছে নীল আলো-জ্বালা গরে
রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়-
থুতু ও পেচ্ছাব সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে-

এ-রকম ছবি দেখে বাতাস অসহ্য হয় বুকের ভিতরে খুব
কশা অভিমানে
শব্দ অপমান করে- ভয় আমাক নিয়ে যায় পুনরায় দক্ষিণ নগরে
মহিম হালদার স্ট্রীটে ঘুরে ফিরে ঘুরে আমি মহিম, মহিম
বলে ডাকাডাকি করি, কেই নেই, মহিম, মহিম, এসো তুমি আর
আমি ও মোহিনী
ফের খেলা শুরু করি, মহিম! মোহিনী।
কোনো সাড়া নেই। ক্রমশ গম্ভীর হয় বাড়িগুলি, আলো
হাড় হিম হয়ে আসে স্মৃতিনষ্ট শীতে।।

জুয়া

অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ,
হাতঘড়ি ও কলম, পকেট বই, রুমাল-
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে,- বিদায় নিলাম,- সন্ধেবেলার রক্তবর্ণ বাতাস ও শেষ
শীতের মধ্যে, একা সিঁড়ি দিয়ে নামবার
সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গী ও দুঃখ, হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।

হাল্‌কা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমি নিখিলেশ হয়ে বহুদূর
হেঁটে গেলাম, নতুন গোধূলি ও রাত্রি, বাড়ি ও দরজা এমনটি অন্তঃপুর

ঘুঁমোবার আগে চুরুট, ঘুমের গভীরতা ও জাগরণ-
ছ’লক্ষ অ্যালার্ম ঘড়ি কলকাতার হিম আস্তরণ
ভাঙার আগেই আমি, অর্থাৎ নিখিলেশ, টেলিফোনে নিখিলেশ
অর্থাৎ সুনীলকে
ডেকে বলি, তুই কি রোড কন্ডেন্স্‌ড্‌ মিল্কে
চা খেতিস? বদ গন্ধ, তা হোক! আমি অর্থাৎ পুরোনো সুনীল,
নিখিলেশ এখন,
তোর অর্থাৎ পুরোনো নিখিল অর্থাৎ নতুন সুনীলের সিংহাসন
এবং হৃঃপিন্ড ও শোণিত
পেতে চাই, তোর পুরোনো ভবিষ্যৎ কিংবা আমার নতুন অতীত
তোর নতুন অতীতের মধ্যে, আমার পুরোনো ভবিষ্যতে
(কিংবা তোর ভবিষ্যতে আমার অতীত কোনো পঞ্চম অতীত ভবিষ্যতে)
কিংবা তোর নিঃসঙ্গতা, আমার না-বেঁচে-থাকা হৈ-হৈ জগতে
দু’রকম স্মৃতি ও বিস্মরণ, যেন স্বপ্ন কিংবা স্পপ্ন বদলের
বীয়ার ও রামের নেশা, বন্ধুহীন, বন্ধু ও দলের
আড়ালে প্রেম ও প্রেমহীনতা, দুঃখ ও দুঃখের মতো অবিশ্বাস
জীবনের তীব্র চুপ, যে-রকম মৃতের নিঃশ্বাস,-
লোভ ও শান্তির মুখোমুখি এসে আমার পূজা ও নারীহত্যা
তোর দিকে, রক্ত ও সৃষ্টির মধ্যে আমি অগত্যা
প্রেমিকার দিকে যাবো, স্তনের ওপরে মুখ, মুখ নয়, ধ্যান ও অসি’রতা
এক জীবনে, ঊরুর সামনে ঊরু, ঊরু নয়, যোনির সামনে লিঙ্গ, অশরীরী,
ঘৃণা ও মমতা
অসম্ভব তান্ডব কিংবা চেয়ে দেখা মুহূর্তের রৌদ্রে কোনো কুরূপা অস্পরী
শীত করলে অন্ধকারে শোবে। দুপুরে হঠাৎ রাস্তায় আমি তোকে
সুনীল সুনীল বলে ডেকে উঠবো, পুরোনো আমার নামে, দেখতে চাই চোখে
একশো আট পল্লব কাঁপে কি না, কতটা বাতাস লাগে গালে ও হৃদয়ে
ক’হাজার আলপিন, কত রূপান্তর জন্মে, শোকে পরাজয়ে,
সুখ, সুখ নয় পাপ, পাপ নয়, দোলে, দোলে না, ভাঙে, ভাঙে না, মৃত্যু, স্রোতে
আমি, ও আমার মতো, আমার মতো ও আমি, আমি নয়,
এক জীবন দৌড়াতে দৌড়াতে।।

শুধু কবিতার জন্য

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, মুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

Tuesday, August 17, 2010

বন্দী শিবির থেকে

শামসুর রাহমান
...............
ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।

স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।

Tuesday, June 22, 2010

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
.............
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
শূন্যতার দিকে চোখ, শূন্যতা চোখের ভেতরও--
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ।
মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে
তুষারের গহন সৌরভ ব'য়ে আর আনে না এখন।

দৃশ্যমান প্রযুক্তির জটা জুটে অবরুদ্ধ কাল,
পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঝ'রে পড়ে সোনালী অসুখ।
ডাক শুনে পেছনে তাকাই-- কেউ নেই।
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি একা....
সমকালীন সুন্দরীগণ অতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে
অভিজাত বেডরুমে,
মূল্যবান আসবাবপত্রের মতন নির্বিকার।
সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয়
আর প্রশংসিত পচনের দিকে।

উজ্জ্বলতার দিকে চোখ, চেয়ে আছি--
ডীপ ফ্রিজে হিমায়িত কষ্টের পাশেই প্রলোভন,
অতৃপ্ত শরীর গুলো খুঁজে নিচ্ছে চোরাপথ-- সেক্সড্রেন।

রুগ্নতার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা বিলাচ্ছে অপচয়--
মায়াবী আলোর নিচে চমৎকার হৈ চৈ, নীল রক্ত, নীল ছবি

জেগে ওঠে একখন্ড ধারালো ইস্পাত--চকচকে,
খুলির ভেতরে তার নড়াচড়া টের পাই শুধু।

ইতিমধ্যে ককটেলে ছিন্নভিন্ন পরিচয়,সম্পর্ক,পদবী--
উজ্জ্বলতার ভেতরে ফণা তুলে আর এক ভিন্ন অন্ধকার।
গ্লাসভর্তি অন্ধকার উল্টে দিই এই অন্ধকারে।

Wednesday, June 9, 2010

ঘুমের আগে

আহসান হাবীব
.........
জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।

মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে ?
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !

আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ?
সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন
ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন
আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে
বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে,
আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না।
জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।

বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,
কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।

একবার বলেছি তোমাকে

আহসান হাবীব
............
একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
একবার বলেছি, তোমাকে আমি, তোমাকেই ভালোবাসি।
বল
এখন সে কথা আমি ফেরাব কেমনে !
আমি একবার বলেছি তোমাকে …

এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি।
এখন তোমার
দৃষ্টির কবলে এলে ক্ষতস্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে।
তোমার সান্নিধ্যে এলে তুমি উষ্ণ নাভিমূল থেকে
বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিনীর তরল নিঃস্বাস। আমি
যতবার ছুটতে চাই, তোমার দৃষ্টির বাইরে যেতে চাই, তুমি
দু চোখে কী ইন্দ্রজাল মেলে রাখ ! আমি ছুটতেও পারি না
আমি ফেরাতে পারি না কথা
আমি একবার বলেছি, তোমাকে …

সম্রাজ্ঞীর বেশে আছ। নতজানু আমি
দাসানুদাসের ভঙ্গি করপুটে, দেখি
তোমার মুখের রেখা অবিচল, স্থির জঙ্ঘা তোলে না টঙ্কার,
তুমি পবিত্রতা পবিত্রতা বলে
অস্পষ্ট চিত্কার কর, তুমি
কেবলি মালিন্য দেখ, অশ্লীলতা, ক্রমান্বয়ে ঘৃণা
ক্রোধ বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে
নামে উষ্ণ জলস্রোত। তুমি
এইভাবে প্রবল ঘৃণায়
আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে অহঙ্কার রাখতে চাও অটুট। তবুও
পৃথিবীতে আছে কিছু মানুষের অবস্থান, তারা
অপমানে ধন্য হয়
উপেক্ষায় ঋজু;
তারা স্বভাব-কাঙাল ! যদি
একবার বলে তবে ফেরাতে পারে না। আমি
ফেরাতে পারি না। আমি
একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা
ভালোবাসা ! সে কেমন, কোন দীপ্র স্বর্গীয় প্রতাপ
যার মৃত্যু নেই
জন্মান্তর নেই?

Tuesday, June 8, 2010

যা চেয়েছি যা পাবো না

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
...............
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী...
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব--শৈশবের হাওয়া শুধু জানে

-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই--দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু'হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে--
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু'চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

আনিসুল হক
.................
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।

তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?

Thursday, May 13, 2010

দোতলার ল্যন্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একজন সিঁড়িতে, একজন দরোজায়-

আহসান হাবীব
..........

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চ’লে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দু’য়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার ডাকনাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইনাল, তাই নয়?
: এবার ফাইনাল
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কি আশ্বর্য। আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে ব’সে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কি ক’রে জানলেন?
: এই আর কি। সেরে গেছে?
: ও কিছু না, প্যাসেজটা পিছল ছিলো মানে…
: সত্যি নয়। উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই? বছর দুয়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এলো, মা এলেন, যাই।
: যাই। আপনি সন্ধেবেলা ওভাবে পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।

এই মাতোয়ালা রাইত

শামসুর রাহমান
.....................
হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও

আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।

আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, 'তুমি
ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।'

আমার গলায় কার গীত হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোন্হানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার, আশক
জমাদার লেইন, বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।

আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।

এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।

এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই।

তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!

Wednesday, May 5, 2010

দ্বিধা

মহাদেব সাহা
.........................
আমি এখনো বহু বিষয়ে মন ঠিক করতে পারিনি
যেমন কোনোদিন আমি বিয়ে করবো কি করবো না
অথবা কোনোদিন যাবো কি না বেশ্যালয়ে
কাউকে কখনো খুন করবো কি,
কোনোদিন চরস খেয়ে পড়ে থাকবো কিনা রাস্তায়
অথবা কিনা কোনো ফকির দরবেশের সাথে চলে
যাবো ধর্মশালায়
কোনো একদিন লাটভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের এই দুঃখ-
ধান্ধার জন্যে
খুব চেঁচিয়ে গালাগাল করবো কি না
একদিন সারারাত ঢিল ছুঁড়ে ভাঙবো কিনা ডিআইটি-র ঘরি
কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা
পাওয়ার হাউসের সুইচটা টিপে
সারা শহরে বাধিয়ে দেবো কি না ভুতুরে কান্ড
……………………………….
……………………………….
মতিঘিলের বাণিজ্য এলাকায় পর পর কয়েক সপ্তাহ চালাবো
কিনা হরতাল
অথবা সস্তা জনসেবার বক্তৃতা দিয়ে নিজের আখের গোছাবো কিনা
নাকি হুজুর হুজুর করে কাটিয়ে দেবো জীবনটা
সত্যি কোনোদিন আমি এই দায়িত্বশীল লোকটা
যাচ্ছেতাই একটা কিছু করে বসবো কিনা
এমনি বহু বিষয়ে আমি এখনো মন ঠিক করতে পারিনি-

যে যে কারনে আমি কষ্ট পাই

মাহাদেব সাহা
...............

খেতে বসে, ঘুমোতে গিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে আমি কষ্ট পাই

কোনোদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলে
গোলাপ ছিঁড়তে গিয়ে কষ্ট পাই
আমি কষ্ট পাই আকস্মিক, কথা
বলতে বলতে অপ্রত্যাশিতভাবে
আমি কষ্ট পাই রেস্তরাঁয়, পার্কে,
সিনেমা হলে, পোস্টাপিসের বারান্দায়
সহকর্মীদের পাশে বসে চা খেতে খেতে,
আমি প্রতিদিন বিভিন্নভাবে কষ্ট পাই

কারো সাথে কোনো মনোমালিন্য থেকে নয়,
কখনো কারো কুৎসা বা ভৎসনা শুনেও নয়
বন্ধুদের আপ্যায়নে ও উপেক্ষায় আমি কষ্ট পাই
ছবি দেখার মতো পয়সা না থাকলে
কষ্ট পাই, ছবি দেখতে গিয়েও কষ্ট পাই

অনেকদিন কারো চিঠি না পেলে
আমি কষ্ট পাই,
চিঠি পেয়েও কষ্ট পাই
আমার চোখের মধ্যে সূর্যাস্ত দেখে
আমি কষ্ট পাই
আমি কষ্ট পাই সকালবেলার আলোতে
অন্ধকারেও সারারাত

প্রতিদিন এমনি বহুভাবে কষ্ট পাই,
ফুলের জন্যে, পাখির জন্যে
সামান্য একটা শাদা পয়সার জন্যে
অহেতুক এমনি এমনি আমি
কষ্ট পাই

বিরহ

বিরহ
.......................
মনে পড়ে লিংক রোড দিয়ে সে গেছে অনেক দূরে
টিলার বাড়িতে
এইখানে খালি ঘরে বৃষ্টির মতো জমেছে বিরহ;
মনে হয় সমস্ত আকাশ যেন বৈষ্ণব কবিতা
বর্ষা বৃষ্টি চৈত্র যায়, যে যায় সে আর ফেরে না।
সে যে ভিতরবাড়ি মার্বেলের মতো পুকুরের জল
এখানে কি সেই মন হুহু-করা ব্যাকুল বিচ্ছেদ, ধু ধু
উধাও প্রান্তর?
আমি এই আকাশের ঠিক কোনো অর্থ জানি না,
শৈশবের ধূসর
্নৃতিতে সেই সার্কাসের তাঁবু, বিষণ্ন আমব্রেলা
চৈত্র শেষ, পাঠ করো শীত কি হেমন্ত।

আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি

সুনীল

আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়িরে ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্‌ড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।

যাতায়াত

হেলাল হাফিজ
....................
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানে না

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুন পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও
কেউ বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখের জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।

কেউ ডাকে নি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

অ্যালেন গিন্সবার্গ কবিতার বাংলা অনুবাদ।
.............................
শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল,
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ,
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।
কারকাছে বলি ভাতরূটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রান,
কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও, মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রান।
কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা,
জননীর কোলে আধপেটা শিশু একেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা।
ছোটো ছোটো তুমি মানুষের দল, তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া,
গুলিতে ছিন্ন দেহ মন মাটি, ঘর ছেড়েছোতো মাটি মিছে মায়া।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,
যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেনো মরে।
শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল,
যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে॥

মে-দিনের কবিতা

সুভাষ মুখোপাধ্যায়
................
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।

চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে--
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।

প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে
মারণের পণ নখদন্তে;
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিক্-অন্তে।

শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিশ্বাসে আনে লজ্জা।
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না--
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।

বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাস
..........................

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

অভিশাপ

কাজী নজরুল ইসলাম
.......................
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি'
যেদিন আমায় খুঁজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, -
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব'সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব'লবে সবাই - "সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?"
আসবে ভেঙে কান্না!
প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ'রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!
বুকের মালা ক'রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

Monday, March 22, 2010

সেই গল্পটা

পূর্ণেন্দু পত্রী
...........
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসে ছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।

সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।

ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্‌ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।

এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারল না।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।

Wednesday, March 10, 2010

মন ভালো নেই

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
--------
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই

কেউ তা বোঝে না
সকলি গোপন
মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু
চোখ বুজে আছি
কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে
দিন কেটে যায়
আশায় আশায় আশায় আশায়

এখন আমার
ওষ্ঠে লাগে না
কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমন কি সুরা এমন কি ভাষা

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
বিকেল বেলায়
একলা একলা
পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে

কিছুই খুঁজি না
কোথাও যাই না
কাউকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ
আমার কী আছে
অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে
বীজের ভিতরে
ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে
দিন কেটে যায়
আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়।।

Tuesday, March 9, 2010

উপেক্ষা

নির্মলেন্দু গুণ
--------
অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷
আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?

এক গাঁয়ে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.................
আমরা দু'জন একটি গাঁয়ে থাকি
সে আমাদের একটিমাত্র সুখ
তাদের গাছে গায়যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দু'টি পালন করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙ্গে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের পরে নেই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

দুইটি পাড়ায় বড়ই কাছাকাছি
মাঝখানে শুধু একটি মাঠের ফাঁক
তাদের বনের অনেক মধু-মাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটের পূজার জবা মালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে
তাদের পাড়ার কুসুম ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

আমাদের এই গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেত তখন ফোটে শন ।
তাদের ছাদে যখন উঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা
আমার বনে কদম ফোটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

Sunday, February 21, 2010

একটি হারানো প্রেম

নির্মলেন্দু গুণ
..............
তুমি যখন ফুল কুড়াতে যেতে
পুকুর-পাড়ে বকুল গাছের তলে,

আমি তোমায় ঝরা বকুল সেজে
টেনে নিতেম পুকুরভরা জলে।

তুমি বুঝতে পারতে না সেই খেলা,
বকুলবেশে ডাক দিয়েছে কে যে!

তখন তুমি সাঁতারও জানতে না।
তোমার প্রণয় ভিক্ষা পাব ভেবে,
আমি তোমায় দীক্ষা দিয়েছিলাম।

তুমি এখন নিজেই বকুল গাছ,
তৈরি হচ্ছো ফুল ফোটাবে বলে।
তাইতো তুমি আগের মতন আর
আসো না ওই বকুল গাছের তলে।

আসবে কেন? আসবে কেন তুমি?
ফুল কখনও ফুল কুড়াতে আসে?
বকুল এখন তোমার পায়ে লোটে,
হাজার পুরুষ তোমায় ভালোবাসে।

বকুল গাছটি অমনি আছে আজও,
পুকুরটিও রয়েছে সেইখানে−।
তুমিই শুধু নেই সকালের মতো
বদলে গেছে তোমার সকল মানে।

তুমি এখন সন্তরণে পটু−,
আমি ভুলে গেছি সাঁতার কাটা।
বকুল ফুলের গন্ধ এখন কটু,
আমার পথে পাথর এবং কাঁটা।

বকুল ভালোবাসবে কেন তুমি?
ছোট্ট পুকুর এখন অথৈ সাগর,
বকুলতলা স্নৃতির বেলাভুমি।

তুমিই শুধু তুমি

সৈয়দ শামসুল হক
....................
তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।

আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।

করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।

বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি−

নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।

এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব−
যেদিকে যাই−তুমিই শুধু−তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!

ফিদেলের জন্য গান

[১৯৫৪ সালের দিকে চে গুয়েভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো যখন গেরিলা যুদ্ধের জন্য কিউবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন এই কবিতাটি লেখেন চে। রক্তাভ ও আবেগঘন এই কবিতায় কাস্ত্রোর প্রতি চের গভীর অনুরাগের পরিচয়আছে।]
----------------
তুমি বলেছিলে সুর্যোদয় হবে।
চলো যাই,
সেই অচিহ্নিত পথে
তোমার ভালোবাসার সবুজ কুমিরকে*
মুক্ত করতে।

এবং চলো আমরা
সকল উপেক্ষাকে তুচ্ছ করি
বিদ্রোহী প্রগাঢ় নক্ষত্র প্লাবিত ভ্রূকুটিতে।
হয় বিজয়ী হব
নয়তো মৃত্যুকে যাব পেরিয়ে।

প্রথম গুলিতেই সারাটা জঙ্গল
উঠবে জেগে সতেজ বিস্নয়ে।
আর তখনই সেখানে
তোমার পাশে
আমরাও থাকব
স্িমগ্ধ সাহচর্যে।

যখন তোমার কন্ঠস্বর বাতাসকে করবে
চার ফালি−
ভুমি সংস্কার, সুবিচার, রুটি, স্বাধীনতা
সেখানে আমরাও থাকব
তোমার পাশে,
আমাদের কন্ঠে ধ্বনিত হবে−
একই উচ্চারণ।
দিনের শেষে
অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযান
সাঙ্গ হলে,
তখন দেখবে সেখানে
শেষ যুদ্ধে
আমরাও রয়েছি
তোমার পাশে।

যখন বন্য পশু চাটে তার ক্ষত
যেখানে বিদ্ধ কিউবার বর্শা,
তখন গর্বিত হূদয়ে আমরা থাকব
তোমার পাশে।

ভেবো না ওই সব উপহারসমেত
ব্যাঙের মতো লাফিয়ে বেড়ানো
তমঘা-আঁটা মাছিরা
আমাদের সংহতি করতে পারবে বিনষ্ট,
আমরা চাই তাদের রাইফেল, বুলেট
আর এক টুকরো পাথর
অন্য কিছুই নয়।

আমেরিকার ইতিহাস রচনায়
আমাদের সামনে যদি
ইস্পাত-বাধা আসে
তাহলে আমাদের গেরিলা অস্িথ
ঢাকার জন্য চাই শুধু কিউবার অশ্রুধারা−
আর কিছু নয়।

* এ কবিতার ‘সবুজ কুমির’ স্পষ্টতই কিউবার প্রতীক। শ্যামলিমা কিউবার মানচিত্রের রূপ কুমির আকৃতির। কিউবার বিপ্লবী কবি নোকোলাস গিয়েনই চিড়িয়াখানা ও অন্যান্য কবিতা বইটির এক কবিতায় প্রথম কুমিরের প্রতীকার্থে কিউবার উল্লেখ করেছিলেন।
অনুবাদ: মতিউর রহমান

A TRUE LOVE

CHUCKSTARR
----------
You dwell in the shadows of my mind
And in the heart that beats inside of me
You are in the wind and rain as they reach my body
You capture me with rays of the sun and bring me warmth

Softly I whisper the sound of your name
The joy I feel is overwhelming
You are in the moon that lights my pathway as I walk at night
You make my eyes flash like the stars twinkling in the skies

My heart pounds as thunderous waves against the shore
At the mere mention of your name
Sweet sounds of birds singing announce your presence
When you are near

The sun is setting from the sky, so does the peace you bring- abide
And in the quiet of the evening shadows the silence brings
Thoughts of you to the fore...
Awakening and stirring passions within

By your side is where I wish to remain and in your arms, forevermore
Feeling the safety of your tender harbor, as a ship when it sights shore
Your smile is the day's beginning and lovingly brings it to a close
Your voice is like a gentle lullaby that cradles my very soul

I am filled with the love of your being
Blessed by the day you were born
Favored with the privilege and gift of having met you
And knowing you love me in return

Saturday, February 20, 2010

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি

নির্মলেন্দু গুণ
---------
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হ’য়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহীদ মিনার থেকে খ’সে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো
কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যায় এই কালো কোকিলটি জেনে যাক -
আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সে স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

আসাদের শার্ট শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান
----------
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এ্যভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

অভিশাপ দিচ্ছি

শামসুর রাহমান
------------------
না আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।

আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে
শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু
সেই সব পশুদের।

ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে
নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি
আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ
দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা। প্রেতায়িত
সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি...

Tuesday, February 16, 2010

নিঃসঙ্গতা

আবুল হাসান
--------
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!

গুচ্ছ কবিতা

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
----------
১.
থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক
একলা থাকার খুব দুপুরে
একটি ঘুঘু ডাকুক
২.
দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা
বুঝতে কেন পাছো না ছাই
মানুষ আমি, যন্ত্র না!
৩.
চোখ কেড়েছে চোখ
উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।

শুধু তোমার জন্য

নির্মলেন্দু গুণ
------

কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।

Monday, February 15, 2010

শূন্যের ভিতরে ঢেঊ

শঙ্খ ঘোষ
.....
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?

মনে পড়ে

মহাদেব সাহা
-------
এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
মনে পড়ে মেঘ, মনে পড়ে চাঁদ,
জলের ধারা কেমন ছিলো-
সেসব কথাই মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে, নদীর কথা মনে পড়ে,
তোমার কথা মনে পড়ে,
এখন এই গভীর রাতে মনে পড়ে
তোমার মুখ, তোমার ছায়া,
তোমার বাড়ির ভেতর-মহল,
তোমার উঠোন, সন্ধ্যাতারা
এখন শুধু মনে পড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে;
তোমার কথা মনে পড়ে
অনেক কথা মনে পড়ে,
এখন শুধু মনে পড়ে, এখন শুধু মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
আকাশে মেঘ থেকে থেকে
এখন বুঝি বৃষ্টি ঝরে।

এ জীবন আমার নয়

মহাদেব সাহা
--------
এ জীবন আমার নয়, আমি বেঁচে আছি
অন্য কোনো পাখির জীবনে,
কোনো উদ্ভিদের জীবনে আমি বেঁচে আমি
লতাগুল্ম-ফুলের জীবনে;
মনে হয় চাঁদের বুকের কোনো আদিম পাথার আমি
ভস্মকণা,
ভাসমান একটু শ্যাওলা আমি;
এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়
আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে,
পাখি, ফুল, ঘাসের জীবনে।
আমি তো জন্মেই মৃত, বেঁচে আছি
অন্য এক জলের উদ্ভিদ-
আমার শরীর এইসব সামদ্রিক প্রাণীদের
সামান্য দেহের অংশ,
আমি কোটি কোটি বছরের পুরাতন একটি
বৃক্ষের পাতা
একবিন্দু প্রাণের উৎস, জীবনের
সামান্য একটি কোষ;
এ জীবন আমার নয় আমি সেইসব অন্তহীন
জীবনের একটি জীবন,
আমি বেঁচে আছি অন্য জীবনে, অন্য
স্বপ্ন-ভালোবাসায়।

অমলকান্তি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
---------
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

শাসকের প্রতি

জয় গোস্বামী
........
আপনি যা বলবেন
আমি ঠিক তাই কোরবো
তাই খাবো
তাই পরবো
তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো
কথাটি না বলে
বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত
তাই থাকবো
পরদিন যখন বলবেন
এবার নেমে এসো
তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে
একা একা নামতো পারবো না
ও টুকু পারি নি বলে
অপরাধ নেবেন না যেন

কথা আছে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
...........
বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।

মেয়েদের পদবী

সুকান্ত ভট্টাচার্য
................
মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা;
‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘ দাস’ হলে ‘দাসা’
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- “সরা”।
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’
বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা।।

মিথিলার চিঠি

অনন্ত,
মেহেদী পাতা দেখেছো নিশ্চয়ই। ওপরে সবুজ, ভেতরে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত। নিজেকে আজকাল বড় বেশী মেহেদী পাতার মতো মনে হয় কেন? ওপরে আমি অথচ ভেতরে কষ্টের যন্ত্রণার এমন সব বড় বড় গর্ত যে, তার সামনে দাঁড়াতে নিজেরই ভয় হয় অনন্ত। তুমি কেমন আছো? বিরক্ত হচ্ছো না তো? ভালোবাসা যে মানুষকে অসহায়ও করে তুলতে পারে সেদিন তোমায় দেখার আগ পর্যন্ত আমার জানা ছিলো না। তোমার উদ্দাম ভালোবাসার দ্যুতি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলেছে আমার ভেতর আমার বাহির। আমারই হাতে গড়া আমার পৃথিবী।

অনন্ত, যে মিথীলা সুখী হবে বলে ভালোবাসার পূর্ণ চন্দ্র গিলে খেয়ে ভেজা মেঘের মতো উড়তে উড়তে চলে গেলো আজন্ম শূণ্য অনন্তকে আরো শূণ্য করে দিয়ে তার মুখে এসব কথা মানায় না আমি জানি। কিন্তু আমি আর এভাবে এমন করে পারছি না। আমার চারদিকের দেয়াল জুড়ে থই থই করে আমার স্বপ্ন খুনের রক্ত। উদাস দুপুরে বাতাসে শীষ দেয় তোমার সেই ভালোবাসা, পায়ে পায়ে ঘুরে ফেরে ছায়ার মতন তোমারই স্মৃতি, আমি আগলাতেও পারি না, আমি ফেলতেও পারি না। সুখী হতে চেয়ে এখন দেখি দাঁড়িয়ে আছি একলা আমি; কষ্টের তুষার পাহাড়ে।

অনন্ত, তোমার সামনে দাড়ানোর কোনো যোগ্যতাই আজ আমার অবশিষ্ট নেই, তবুও ... তবুও তুমিই একদিন বলেছিলে, "ভেজা মেঘের মতো অবুঝ আকাশে উড়তে উড়তে জীবনের সুতোয় যদি টান পড়ে কখনো, চলে এসো ... চলে এসো, বুক পেতে দেবো, আকাশ বানাবো আর হাসনুহেনা ফোটাবো"।

সুতোয় আমার টান পড়েছে অনন্ত, তাই আজ আমার সবকিছু, আমার একরোখা জেদ, তুমিহীন সুখী হওয়ার অলীক স্বপ্ন, সব ... সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার সামনে আমি নতজানু। আমায় তোমাকে আর একবার ভিক্ষে দাও। কথা দিচ্ছি তোমার অমর্যাদা হবে না কোনোদিন। অনন্ত, আমি জানি, এখন তুমি একলা পাষাণ কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াও। প্রচন্ড এক অভিমানে ক্ষণে ক্ষণে গর্জে ওঠে অগ্নিগিরি। কেউ জানে না, আমি জানি। কেন তোমার মনের মাঝে মন থাকে না। ঘরের মাঝে ঘর থাকে না। উঠোন জোড়া রূপোর কলস, তুলসী তলের ঝরা পাতা, কুয়োতলার শূণ্য বালতি; বাসন-কোসন, পূর্ণিমা আর অমাবস্যা, একলা ঘরে এই অনন্ত, একা একা শুয়ে থাকা, কেউ জানে না, আমি জানি। কেন তুমি এমন করে কষ্ট পেলে? সব হারিয়ে বুকের তলের চিতানলে, কেন তুমি নষ্ট হলে? কার বিহনে চুপি চুপি ধীরে ধীরে, কেউ জানে না আমি জানি, আমিই জানি।

আগামী শনিবার ভোরের ট্রেনে তোমার কাছে আসছি। অনন্ত, আমায় আর কিছু না দাও, অন্তত শাস্তিটুকু দিও। ভালো থেকো।

তোমারই হারিয়ে যাওয়া,
মিথীলা

সেই গল্পটা

সেই গল্পটা
পূর্ণেন্দু পত্রী
....................
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।

সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।

ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্‌ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।

এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারলনা।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।

Sunday, February 14, 2010

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ - নির্মলেন্দু গুণ

নেকাব্বর জানে তাঁর সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না
কেউ কোনোদিন।
এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন, 'কী কইরা
পালবা আমারে,

তোমার কী আছে কিছু তেনা?'
সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু'হাতে বুকে পিষে
বলেছিল নেকাব্বর;

'আছে, আছে, লোহার চাককার মতো দুটা হাত,
গতরে আত্তীর বল - আর কীডা চাস্ মাগী।'
'তুমি বুঝি খাবা কলাগাছ?'

আজ এই গোধুলিবেলায় প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালা চোখে নিয়ে
নেকাব্বর সহসা তাকালো ফিরে সেই কলাবাগানের গাঢ় অন্ধকারে।
তিরিশ বছর পরে আজ বুঝি সত্য হলো ফাতেমার মিষ্টি উপহাস।
পাকস্থলি জ্বলে ওঠে ক্ষুধার আগুনে, মনে হয় গিলে খায়
সাজানো কদলীবন,'
যদি ফের ফিরে পায় এতটুকু শক্তি দুটি হাতে, যদি পায়
দাঁড়াবার মতো এতটুকু শক্তি দুটি পায়ে।

কিন্তু সে কি ফিরে পাবে ফের?
ফাতেমার মতো ফাঁকি দিয়া সময় গিয়েছে ঢের চলে।
কারা যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে সব শক্তি তার।
বিনিময়ে দিয়ে দেছে ব্যাধি, জরা, দুর্বলতা, বক্ষে ক্ষয়কাশ-
অনাদরে, অনাহারে কবরে ডুবেছে সূর্য, ফাতেমার তিরিশ বছর।
এখন কোথায় যাবে নেকাব্বর?

হয়তো গিলেছে নদী তার শেষ ভিটেখানি, কবর ফাতেমা-
কিন্তু তার শ্রম. তার দেহবল, তার অকৃত্রিম নিষ্ঠা কারা নিলো?
আজ এই গোধুলিবেলায় এই যে আমার পৃথিবীকে মনে হলো পাপ,
মনে হলো হাবিয়া দোজখ - কেউ কি নেবে না তার এতটুকু দায়?
মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চায় না সুদুরে চলে যেতে, নেকাব্বর ভাবে,
অজানা অচেনা স্বর্গে বুঝি মেটে বাস্তবের তৃষ্ণা কোনোদিন?
তবু যারা চায়, তারা কেন চায়? তারা কেন চায়? কেন চায়?

নেকাব্বর শুয়ে আছে জীবনের শেষ ইস্টিশনে। তার পচা বাসী শব
ঘিরে আছে সাংবাদিক দল। কেউ বলে অনাহারে, কেউ বলে অপুষ্টিতে,
কেউ বলে বার্ধক্যজনিত ব্যাধি, - নেকাব্বর কিছুই বলে না।

প্রতীক্ষা

প্রতীক্ষা
রফিক আজাদ
..................................
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা ঝরার শব্দ শুনবো বলে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে
কোন বন্ধুর জন্যে কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপক্ষা করবো ...
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপক্ষা ক’রো একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধুর ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তোবা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেষ্ট বাংলো;
আমি অপেক্ষায় থেকেছি

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয় বন্ধু আলোক মিত্র ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ ও মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতে ও পারিস,
তৈরী থাকিস আমি আসবো”
আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি-শত্রুর জন্যেও অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে অপেক্ষায় থেকেছি-
কিন্তু তোমার জন্যে আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ -দু’টির তেমন কোনো আলাদা মানে নেই
কিন্তু আমরা দু’জন জানি ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন, অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্য প্রতীক্ষা করবো না?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকবো
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার পায়ে শিকড় গজাবে ...
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না ...

প্রতিদান

প্রতিদান
জসীম উদ্দীন
-------------------------------------------------------------------------------
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান,
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

যদি ভালবাসা পাই

কবিঃ রফিক আজাদ

যদি ভালবাসা পাই
আবার শুধরে নিব জীবনের ভুল গুলি

যদি ভালবাসা পাই
ব্যাপক দীর্ঘ পথে তুলে নিব ঝুলা ঝুলি

যদি ভালবাসা পাই
শীতের রাতের শেষে মকমল দিন পাব

যদি ভালবাসা পাই
পাহার ডিঙ্গাব আর সমুদ্র সাঁতরাব

যদি ভালবাসা পাই
আমার আকাশ হবে ধ্রুত শরতের নীল

যদি ভালবাসা পাই
জীবনে আমিও পাব মধ্য অন্তমিল

Saturday, February 6, 2010

নাস্তিক

নাস্তিক
নির্মলেন্দু গুণ

নেই স্বর্গলোভ কিংবা কল্প-নরকের ভয়,
অলীক সাফল্যমুক্ত কর্মময় পৃথিবী আমার৷
চর্মচোখে যা যা দেখি, শারীরিক ইন্দ্রিয় যা ধরে,
তাকেই গ্রহন করি৷ জানি, নিরাকার অপ্রত্যক্ষ
শুধুই ছলনা, বিশ্বাস করি না ভাগ্যে, দেবতার বরে৷
আমার জগত্ মুগ্ধ বাস্তবের বস্তুপুঞ্জে ঠাসা,
তাই সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অতীন্দ্রিয় নয়৷
অন্ধতার বধ্যভূমি আমার হদৃয়৷
সেই শ্রেষ্ঠ মানব-সন্তান, যার মন মুক্ত ভগবান৷
আমার মস্তক নিত্য নত সেই নাস্তিকের তরে৷

আমার জন্ম

আমার জন্ম
নির্মলেন্দু গুণ

তপ শেষে যখন বাল্মীকি তাঁর মুদিত নয়ন
খুলিলেন, দেখিলেন লব নেই; চোখের সমুখে
দিগন্তবিস্তৃত ধু-ধু শূন্য তপোবন প’ড়ে আছে৷
‘কোথা লব, কোথা লব? ফিরে আয়৷’ ডাকিলেন মুনি,
ফিরে এলো প্রতিধ্বনি, শিশু লব দিলো না উত্তর৷
এ কোন্ বিধির লীলা, ভাবিলেন চিন্তক্লীষ্ট মুনি:
‘শুন্য হাতে কী মুখে যাইব আজ সেই পূণ্যাশ্রমে,
– যেখানে অকল্পনীয় লব-হীন সীতার জীবন৷’
যোগসিদ্ধ ঋষি তিনি, দৈববিদ্যা করায়ত্ত তাঁর,
যদি সেই তপলব্ধ দৈবজ্ঞান করিলে প্রয়োগ
মাতৃকোল পূর্ণ হয়, তৃপ্ত করে সীতার হদৃয়–
তবে তাই হোক–, মহামন্ত্রে জন্ম নিল দেবশিশু৷
পেলো প্রাণ-চঞ্চলতা অবিকল লবের মতোন৷
যেহেতু নির্মিত কুশে, তার নাম রাখা হলো কুশ৷
না আমি নির্মিত নই বাল্মীকির কাল্পনিক কুশে,
আমাকে দিয়েছে জন্ম রক্তঝরা অমর একুশে৷

Wednesday, January 27, 2010

William Shakespeare Sonnet 18

Shall I compare thee to a summer's day?
Thou art more lovely and more temperate.
Rough winds do shake the darling buds of May,
And summer's lease hath all too short a date.
Sometime too hot the eye of heaven shines,
And often is his gold complexion dimmed;
And every fair from fair sometime declines,
By chance, or nature's changing course untrimmed.
But thy eternal summer shall not fade
Nor lose possession of that fair thou ow'st;
Nor shall death brag thou wand'rest in his shade,
When in eternal lines to time thou grow'st,
So long as men can breathe or eyes can see,
So long lives this, and this gives life to thee.

Friday, November 13, 2009

যাত্রা-ভঙ্গ

নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷
তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷
তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷
নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷
তুই কেমন করে যাবি?

ওটা কিছু নয়

নির্মলেন্দু গুণ

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।
সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।
অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।

এবারই প্রথম তুমি

নির্মলেন্দু গুণ

ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে
মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না
ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে
ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না৷
ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না
নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি এখানে ছিলে না
এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না
নীল নবঘন গগনে ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷

Saturday, October 3, 2009

মহোদয় বললেন

মহোদয় বললেন
মাকিদ হায়দার

দীর্ঘ জীবনের পথ পরিক্রমায়
কি কি দেখলেন সবিস্তারে
উপস্হাপন করুন।
প্রথমে একটি রেল দেখেছিলাম, সঙ্গে
গাড়িও ছিল, সেই আমার প্রথম রেলগাড়ি দেখা,
ঠিক এর কিছুদিন পরে
হেমায়েতের দোকানে শুনেছিলাম আব্বাসউদ্দীনের গান।
এমন সময় রেললাইন আর আব্বাসউদ্দীনের গানের মাঝখানে
হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায়, তছনছ মেজকাকা
কলিকাতা থেকে
পালিয়ে আসার সময় কানন বালার একখানা ছবি সঙ্গে নিয়ে
এসেছিলেন, পকেটে ছিলো রানী ভিক্টোরিয়ার মাথাওয়ালা টাকা।

লড়কে লেঙ্গের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাবা যে কোথায়
হারিয়ে গেলেন, কেউ যখন কিছুতেই বলতে পারলো না
তখন মা বললেন,
ও আর ফিরবেনা কোনদিন।
মনে আছে, এদিক-সেদিক করে আমরা যেদিন এখানে এসে
পৌঁছালাম, সেদিন বেষপতিবার ছিলো, মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল,
সেই সঙ্গে মা কেঁদেছিলেন খুব, খুব সম্ভবত: বাবার স্মৃতি মনে করে।

এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরির পর একজন অনাত্নীয় একটি সরকারী
চাকরী জুটিয়ে দিয়েছিলেন, শর্ত তার মেয়েটিকে উদ্ধার করে দিতে হবে
দিয়েছিলামও তাই।
মাঝখানে অনেকখানি ফাঁক। তারপরে মুক্তিযুদ্ধের বছরে ছেলেমেয়ে নিয়ে
এলে-বেলে, বলে কয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম, ওপারে বেঁচে গিয়েছিল
মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটিও।
পাড়ার অনেকে সে বছর খুব খাতির যত্নে রেখেছিল আমাদের, বিশেষত:
দেশ স্বাধীন হবার পরে। তারপরে আবার সেই ছেচল্লিশের দাঙ্গায়
যেভাবে মা সহ পথে নেমেছিলাম এবারও তাই, তবে মা ছিলো না
বলে বাবার প্রসঙ্গ ওঠেনি। শুধু প্রসঙ্গ উঠেছিল আমার মুক্তিযোদ্ধা
ছেলেটিকে নিয়ে,
যে আমার বাবার মত ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে আসেনি আজো।
এতো দু:খ-কষ্টের পরেও আব্বাসউদ্দীনের গান, কাননবালার ছবি
এবং আমার জীবনের সমস্ত স্মৃতি আপনার সম্মুখে উপস্থাপন করলাম,
মহোদয়
যদি কোন অপরাধ করে থাকি , যেন ক্ষমার যোগ্য হই।
বিজ্ঞ মহোদয় বললেন,
সব শুনলাম, এবার আপনি নথিতে উপস্থাপন করুন
কেন আপনার ছেলে
মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো ?

তোমার পাশে

তোমার পাশে
মাকিদ হায়দার

ডাকবে শুধু আমায় তুমি
থাকবে শুধু আমার পাশে
থাকবে তুমি।
কাঁদলে শুধু কাঁদবো আমি
বিজন রাতে একলা আমি
তোমার পাশে।
জোনাক আলো জ্বালবো আমি
যেথায় তুমি একলা থাকো
আমায় ছেড়ে।
ডাকবে লোকে হঠাৎ করে
সাতসকালে সাঁঝের বেলা
তখন তুমি বাসর ছেড়ে
একপা দু’পা তিনপা করে
বেড়িয়ে এলে দেখতে পাবে।
দাঁড়িয়ে আছি তোমার পাশে।

আমরা ক-ভাই

আমরা ক-ভাই
মাকিদ হায়দার

কর্তব্যপরায়ন হিসেবে এই মহল্লার সকলেই
সর্বাগ্রে উচ্চারণ করে
আমাদের নাম৷
দেশ বিদেশে যে কেউ এসে জিজ্ঞেস করলেই
একবাক্যে সকলেই উচ্চারণ করেন
ছেলে গুলো ভালো৷
কর্তব্য পরায়ন৷
নির্দেশ মতো সব কিছু করে৷
সমপ্রতি একদল লোক মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছেন
পর্যবেক্ষক হয়ে৷
আমরা ঠিক মতো মাতৃপরায়ণ প্রতি
অবহেলা কতটুকু করি
সেই সাথে বিরোধিতা কতটুকু
বহুটুকু শুধু দেখবেন
পর্যবেক্ষক দল৷
কর্তব্য পরায়নে এ মহল্লায় অদ্বিতীয় বলে
আশা করি আমরা ক-ভাই
অচিরেই পেয়ে যাবো৷
হীরকের মালা৷

Wednesday, September 9, 2009

গুয়েভারার প্রতি

গুয়েভারার প্রতি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দশৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ
থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধেচে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে,
হঠাৎ-ওঠাঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছেচে,
তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

Tuesday, September 8, 2009

হে স্তন্যদায়িনী

হে স্তন্যদায়িনী
পূর্ণেন্দু পত্রী
Font size
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে এত ঘন বিশৃঙ্খলা কেন ?
রক্ত ঝরে না ভেজালে
কোনো সুখ দরজা খোলে না ।
ময়ূরও নাচে না তাকে দু-নম্বরী সেলামী না দিলে ।
হাতুড়ির ঘায়ে না ফাটালে
রাজার ভাঁড়ার থেকে এক মুঠু খুদ খেতে
পায় না চড়ুই ।
স্বপ্নে যারা পেয়ে গেছে সচেতন ফাউন্টেন পেন
তাদেরও কলমে দেখ
সূর্য কীরণের মত কোনো কালি নেই ।
হে স্তন্যদায়িনী
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে প্রতিশ্রুত ভাস্কর্যের পাথর কেবল ।

আমার জন্ম

আমার জন্ম
নির্মলেন্দু গুণ
তপ শেষে যখন বাল্মীকি তাঁর মুদিত নয়ন
খুলিলেন, দেখিলেন লব নেই; চোখের সমুখে
দিগন্তবিস্তৃত ধু-ধু শূন্য তপোবন প’ড়ে আছে৷
‘কোথা লব, কোথা লব? ফিরে আয়৷’ ডাকিলেন মুনি,
ফিরে এলো প্রতিধ্বনি, শিশু লব দিলো না উত্তর৷
এ কোন্ বিধির লীলা, ভাবিলেন চিন্তক্লীষ্ট মুনি:
‘শুন্য হাতে কী মুখে যাইব আজ সেই পূণ্যাশ্রমে,
– যেখানে অকল্পনীয় লব-হীন সীতার জীবন৷’
যোগসিদ্ধ ঋষি তিনি, দৈববিদ্যা করায়ত্ত তাঁর,
যদি সেই তপলব্ধ দৈবজ্ঞান করিলে প্রয়োগ
মাতৃকোল পূর্ণ হয়, তৃপ্ত করে সীতার হদৃয়–
তবে তাই হোক–, মহামন্ত্রে জন্ম নিল দেবশিশু৷
পেলো প্রাণ-চঞ্চলতা অবিকল লবের মতোন৷
যেহেতু নির্মিত কুশে, তার নাম রাখা হলো কুশ৷
না আমি নির্মিত নই বাল্মীকির কাল্পনিক কুশে,
আমাকে দিয়েছে জন্ম রক্তঝরা অমর একুশে৷

আগ্নেয়াস্ত্র

আগ্নেয়াস্ত্র
নির্মলেন্দু গুণ
পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের
সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের
শটগান, রাইফেল, পিস্তল এবং কার্তুজ, যেন দরগার
স্বীকৃত মানৎ; টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত।
আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি
কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক
একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেই নি।

Monday, September 7, 2009

সত্যবদ্ধ অভিমান

সত্যবদ্ধ অভিমান

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে....
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ?

Pages