Sunday, December 19, 2010

আরও নিচে

আরও নিচে
.........
সিংহাসন থেকে একটু নিচে নেমে, পাথরের
সিঁড়ির উপর বসে থাকি
একা, চিবুক নির্ভরশীল
চোখ লোকচক্ষু থেকে দূরে।
‘সম্রাটের চেয়ে কিছু কম সম্রাটত্ব’ থেকে ছুটি নিয়ে আজ
হলুদ দিনাবসানে পরিকীর্ণ শব্দটির মোহে
মাটির মানুষ হতে সাধ হয়। এক-একদিন একরকম হয়।
আমার চোখের নীচে কালো দাগ
ব্যান্ডেজের মধ্যে একটা পোকা ঢুকলে যে-রকম জাদুদন্ডসম কোনো
মহিলার মতো
নিয়তি বদল করে, আলো-ছায়া-আলো ঘোরে নিভৃত সানুদেশে
দপ করে জ্বলে ওঠে হৃদয়ের পুরনো বারুদ
তেমনিই দিনাবসান
তেমনিই মোহের থেকে মুক্ত নিচু চাঁদ-
সিংহাসন থেকে নেমে, হাত ভরা পশমের মতো
রোমশ স্তব্ধতা।

পাথরের মতো মসৃণ বেদির নিচে রুক্ষ মাটি, একটু দূরে পায়ে চলা পথ।
সম্রাটের শেষ বৃত্য চিরতরে যেখানে শয়ান
তার চেয়ে দূরে, সীমার যেখানে শেষ
সেখানে উদ্ভিদ, জল মেতে আছে পাংশু ঈর্ষায়
যেখানে বিশীর্ণ হাত কাদার ভেতর খোঁজ বলির ফসল
তার চেয়ে দূরে
যেখানে শামুক তার খাদ্য পায়, নিজেও সে খাদ্য হয়
ভেসে যায় সাপের খোলস, সেখানেও
আমার অতৃপ্তি বড় দীর্ঘশ্বাস বিষদৃষ্টি নিয়ে জেগে রয়-
মুকুট খোলার পর আমি আরও বহুদূরে নেমে যেতে চাই।।

এক একদিন উদাসীন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
...........
এমনও তো হয় কোনোদিন
পৃথিবী বন্ধবহীন
তুমি যাও রেলব্রীজে এক-
ধূসর সন্ধ্যায় নামে ছায়া
নদীটিও স্থিরকায়া
বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।
ইস্টিশানে অতি ক্ষীণ আলো
তাও কে বেসেছে ভালো
এত প্রিয় এখন দ্যুলোক
হে মানুষ, বিস্মৃত নিমেষে
তুমিও বলেছো হেসে
বেঁচে থাকা স্বপ্নভাঙা শোক!
মনে পড়ে সেই মিথ্যে নেশা?
দাপটে উল্লাসে মেশা
অহঙ্কারী হাতে তরবারী
লোভী দুই চক্ষু চেয়েছিল
সোনার রূপোর ধুলো
প্রভুত্বের বেদী কিংবা নারী!
আজ সবকিছু ফেলে এলে
সূর্য রক্তে ডুবে গেলে
রেলব্রীজে একা কার হাসি?
হাহাকার মেশা উচ্চারণে
কে বলে আপন মনে
আমি পরিত্রাণ ভালোবাসি!

জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.............
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না
মৃত্যু হয় না-
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।
আমার কেউ নাম রখেনি, তিনটে
চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধীমে,
আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার
হাত পুড়ে যায়
অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমায়ায়
অন্ধকারে মিশে থেকেছি
কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোনো ভয় হয় না
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।।

নারী ও শিল্প

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
............
ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি
উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা
এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা
দর্পণের ঘরে বস
চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে
সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল
থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে

আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো
তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব
আমি তার ওষ্ঠ ও উরুতে মুখ গুঁজে
জানাই সেই খবর
কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না।

তুমি যেখানেই যাও

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.............
তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি য়েলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?

তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি
তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেঁসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না
আয়না
ভেঙে
বিচ্ছুরণ
একদিন
বিস্ফোরণ হয়
বুক ভেঙে কান্না এলে কান্নাগুলি ছুটে যায় ধূসর অন্তিমে স্বর্গের অলিন্দে-
স্বর্গ থেকে
তারপর ঢলে পড়ে
মহিম হালদার স্ট্রীটে
প্রাচীন গহ্বরে
মধ্যরাতে।

জানলা ভেঙে বৃষ্টি এলে বুকে যে-রকম পাপ হয়
যে-রকম স্মৃতিহীন মহিম হালদার কিংবা আমি ও মোহিনী
পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রী-শরীর চরিত্র নদীর……
দীপকের মাথাব্যথা হাঁসের পালক ছুঁয়ে হাসাহাসি করে
যে-রকম শান্তিনিকেতন কোনো ত্রিভুবনে নেই
দীপক ও তারাপদ দুই কম্বুকন্ঠ জেগে রয়…….
যে রকম তারাপদ গান গায় গোটা উপন্যাসে সুর দেয়া
কবিতার লাইন ছুঁড়ে পাগলা-ঘন্টি বাজিয়ে ঘুরেছে-

নিকষ বৃত্তের থেকে চোখগুলি ঘোরে ও ঘুমোয়,
শিয়রে পায়ের কাছে বই-বই-বই
তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে।
আরো নিজে পাপোশের নিচে এক আহিরীটোলায়
বৃষ্টি পড়ে,
রোদ আসে,
বিড়ালীর সঙ্গে খেলে
বেজম্মা বালিকা-
ছাদে পায়চারি করে গিরগিটি,

শেয়াল ঢুকেছে নীল আলো-জ্বালা গরে
রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়-
থুতু ও পেচ্ছাব সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে-

এ-রকম ছবি দেখে বাতাস অসহ্য হয় বুকের ভিতরে খুব
কশা অভিমানে
শব্দ অপমান করে- ভয় আমাক নিয়ে যায় পুনরায় দক্ষিণ নগরে
মহিম হালদার স্ট্রীটে ঘুরে ফিরে ঘুরে আমি মহিম, মহিম
বলে ডাকাডাকি করি, কেই নেই, মহিম, মহিম, এসো তুমি আর
আমি ও মোহিনী
ফের খেলা শুরু করি, মহিম! মোহিনী।
কোনো সাড়া নেই। ক্রমশ গম্ভীর হয় বাড়িগুলি, আলো
হাড় হিম হয়ে আসে স্মৃতিনষ্ট শীতে।।

জুয়া

অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ,
হাতঘড়ি ও কলম, পকেট বই, রুমাল-
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে,- বিদায় নিলাম,- সন্ধেবেলার রক্তবর্ণ বাতাস ও শেষ
শীতের মধ্যে, একা সিঁড়ি দিয়ে নামবার
সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গী ও দুঃখ, হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।

হাল্‌কা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমি নিখিলেশ হয়ে বহুদূর
হেঁটে গেলাম, নতুন গোধূলি ও রাত্রি, বাড়ি ও দরজা এমনটি অন্তঃপুর

ঘুঁমোবার আগে চুরুট, ঘুমের গভীরতা ও জাগরণ-
ছ’লক্ষ অ্যালার্ম ঘড়ি কলকাতার হিম আস্তরণ
ভাঙার আগেই আমি, অর্থাৎ নিখিলেশ, টেলিফোনে নিখিলেশ
অর্থাৎ সুনীলকে
ডেকে বলি, তুই কি রোড কন্ডেন্স্‌ড্‌ মিল্কে
চা খেতিস? বদ গন্ধ, তা হোক! আমি অর্থাৎ পুরোনো সুনীল,
নিখিলেশ এখন,
তোর অর্থাৎ পুরোনো নিখিল অর্থাৎ নতুন সুনীলের সিংহাসন
এবং হৃঃপিন্ড ও শোণিত
পেতে চাই, তোর পুরোনো ভবিষ্যৎ কিংবা আমার নতুন অতীত
তোর নতুন অতীতের মধ্যে, আমার পুরোনো ভবিষ্যতে
(কিংবা তোর ভবিষ্যতে আমার অতীত কোনো পঞ্চম অতীত ভবিষ্যতে)
কিংবা তোর নিঃসঙ্গতা, আমার না-বেঁচে-থাকা হৈ-হৈ জগতে
দু’রকম স্মৃতি ও বিস্মরণ, যেন স্বপ্ন কিংবা স্পপ্ন বদলের
বীয়ার ও রামের নেশা, বন্ধুহীন, বন্ধু ও দলের
আড়ালে প্রেম ও প্রেমহীনতা, দুঃখ ও দুঃখের মতো অবিশ্বাস
জীবনের তীব্র চুপ, যে-রকম মৃতের নিঃশ্বাস,-
লোভ ও শান্তির মুখোমুখি এসে আমার পূজা ও নারীহত্যা
তোর দিকে, রক্ত ও সৃষ্টির মধ্যে আমি অগত্যা
প্রেমিকার দিকে যাবো, স্তনের ওপরে মুখ, মুখ নয়, ধ্যান ও অসি’রতা
এক জীবনে, ঊরুর সামনে ঊরু, ঊরু নয়, যোনির সামনে লিঙ্গ, অশরীরী,
ঘৃণা ও মমতা
অসম্ভব তান্ডব কিংবা চেয়ে দেখা মুহূর্তের রৌদ্রে কোনো কুরূপা অস্পরী
শীত করলে অন্ধকারে শোবে। দুপুরে হঠাৎ রাস্তায় আমি তোকে
সুনীল সুনীল বলে ডেকে উঠবো, পুরোনো আমার নামে, দেখতে চাই চোখে
একশো আট পল্লব কাঁপে কি না, কতটা বাতাস লাগে গালে ও হৃদয়ে
ক’হাজার আলপিন, কত রূপান্তর জন্মে, শোকে পরাজয়ে,
সুখ, সুখ নয় পাপ, পাপ নয়, দোলে, দোলে না, ভাঙে, ভাঙে না, মৃত্যু, স্রোতে
আমি, ও আমার মতো, আমার মতো ও আমি, আমি নয়,
এক জীবন দৌড়াতে দৌড়াতে।।

শুধু কবিতার জন্য

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, মুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

Pages