Friday, June 10, 2011

হঠাৎ দেখা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
...........................
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু --
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্‌, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।

Monday, June 6, 2011

সে তোমাকে পাবে না।

মইনুল আহসান সাবের
................
একা একা ভালবেসে এইভাবে বেড়ে যায় পাপ,
তুমি কোনদিন দেখবেনা, তার দুঃখ অনুস্তাপ।
কোন কোন মাঝ রাতে বৃষ্টি হবে,
সে তখন তোমাকে পাবেনা।
বৃষ্টি যেমন ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর বস্ত্র হরণ করে,
টানে টানে খসে যায় আবরণ,
পরে থাকে বিশুদ্ধ যৌবন
ঠিক সেই ভাবে বস্ত্র হরণ করেও,
সে তোমাকে পাবেনা।
কোন কোন দুপুরে নীল আকাশে ভেসে যাবে একা চিল,
সে তখন তোমাকে পাবেনা।
আকাশের মত বিস্তৃত করেও,
সে তোমাকে পাবেনা।
সে তোমার ঠোঁট ছোঁবে, স্তনাগ্র, তোমার চিবুক,
তবু মাঝ রাতে বৃষ্টি হলে তুমি তার হবেনা।

তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টি হলে কেন তুমি ভেসে যাও
কে তোমায় বাজায় তখন,
কার কন্ঠে গান গায় একান্তের স্মৃতি,
কোন সে হাত এসে সিঁথি কাটে তোমার চুলে,
তোমাকে শয্যা থেকে তুলে নেয়,
তোমাকে তোমার শরীর থেকে তুলে নেয়,
কোন সে পুরুষ?
তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, বোঝেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টির অর্থ,
জানেনা নির্জন করিডোরে নতজানু এক নিঃসঙ্গ যুবক,
তোমাকে মাঝরাতে বৃষ্টির কথা বলেছিল,
তোমার চমকিত চোখে বরিষন দেখেছে সে,
বলেছিল তোমার নিজস্ব পুরুষ সে তো জানেনা,
নিজস্ব ছাড়িয়ে আরো কিছু থাকে।

Wednesday, June 1, 2011

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

জীবনানন্দ দাস
..................
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাহাদের হৃদয়।

তোমায় আমি

জীবনানন্দ দাস
...........
তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।

তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।

জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।

Pages